দিনটি ছিল সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গাপূজার নবমী। তাই দিনভর নানা আয়োজনে উলুধ্বনি, ঢোল ও শঙ্খ বাজনার তালে তালে চলছে পূজা অর্চনা। কিন্তু হঠাৎ মসজিদের মাইকে ধ্বনিত হলো আসরের নামাজের আজান। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ঢোলের বাজনা ও পূজা অর্চনা। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় একই উঠানে শতবর্ষী মসজিদ ও মন্দির প্রাঙ্গণে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’— এ বাক্যটির যথার্থই প্রমাণ পাওয়া যায় একই উঠানে পুরান বাজার জামে মসজিদ ও পুরান বাজার কালীবাড়ি দুর্গামন্দিরে। এ যেন ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
দুর্গাপূজার সময় ঢাক ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিয়ে সমস্যা হয় কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় কয়েকজন হিন্দু ও মুসলমান ব্যক্তিরা জানান, আমরা মসজিদ ও মন্দির কমিটির সদস্যরা বসে ঠিক করে নিই কখন এবং কীভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা হবে। নামাজের সময়গুলোয় সকল প্রকার বাদ্য বাজনা বন্ধ রাখা হয় এবং নামাজ শেষে মসুল্লিরা দ্রুত মসজিদ ত্যাগ করে পূজারীদের জন্য সুযোগ করে দেন। এটাই এখানে নিয়ম।
এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ শিকদার আলী (৮০) জানান, দীর্ঘদিন ধরে একই উঠানে মসজিদ-মন্দির হলেও উভয় ধর্মের মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে থেকে স্ব স্ব ধর্ম পালন করে আসছে। ধর্ম পালন নিয়ে কখনো কোনো বাকবিতণ্ডা পর্যন্ত হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। শালীনতা বজায় রেখেই একই উঠানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন উভয় ধর্মের মানুষ। শুধু নামাজ বা পূজা অর্চনাই নয়, উভয় ধর্মের সকল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শান্তিপূর্ণ ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়েই পালন করছেন এখানকার মানুষ।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। যার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেশের নানা প্রান্তে। এমনই একটি দর্শনীয় স্থান লালমনিরহাট জেলা শহরের পুরান বাজার এলাকায় এক উঠানেই মসজিদ ও মন্দির বেশ জনপ্রিয়। প্রতিদিন ভোরে ফজরের সময় মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে মিষ্টি আজান শেষে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করে চলে যাওয়ার পরে পাশেই মন্দিরে শোনা যায় উলুধ্বনি! এমনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন বহন করছে লালমনিরহাট শহরের শতবর্ষী মসজিদ ও মন্দির দুটি।
মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লি গোলাম মোস্তফা (৭৫) জানান, এখানে ধর্ম নিয়ে নেই কোনো হানাহানি ও মতবিরোধ। এসব ছাড়াই এখানে পারস্পরিক সহযোগিতায় ধর্মীয় আচার পালন করে আসছেন স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মানুষরা। ফলে সম্প্রীতির এই স্থানটি দেখতে বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময় দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন এখানে।
মন্দিরের সভাপতি জীবন কুমার সাহা জানান, ১৮৩৬ সালে দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে এখানে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুরান বাজার এলাকা অনেকের কাছে কালীবাড়ি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এরপর মন্দির প্রাঙ্গণে ১৯০০ সালে একটি নামাজঘর নির্মিত হয়। এ নামাজ ঘরটিই পরবর্তীতে পুরান বাজার জামে মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর থেকে কোনো বিবাদ ও ঝামেলা ছাড়াই সম্প্রীতির সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে আসছে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ।
পুরান বাজার জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আসাদুল ইসলাম জানান, যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। উভয় ধর্মের লোকদের সম সুযোগ দিয়েই এখানে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তাই ধর্ম পালনে কারো কোনো সমস্যা হয় না।